গত সপ্তাহে আমার গাইড একটি ইমেল করে ল্যাব এর সকলকে জানালেন যে, আমাদের গবেষণা সংক্রান্ত একটি খুব গুরুত্ত্বপূর্ণ প্রবন্ধ ‘Science’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। আগামী সপ্তাহে সকলে মিলে সেই প্রবন্ধটা নিয়ে আলোচনা করা হবে। আমি মেইলটি দেখলাম এবং এক মুহূর্ত পরেই সেটা সম্পূর্ণ ভুলে গেলাম। তার মানে এই নয় যে, আমি আমার গবেষণার ব্যপারে একেবারেই উদাসীন, কিন্তু কাজের বাইরে হাজার রকমের অকাজ নিয়ে আমার উত্সাহ ঢের বেশি।
সামনের উইকএন্ডে কোথায় ভালমন্দ খাওয়া যেতে
পারে...সেটা রেস্টোরান্টই হোক অথবা কোনও বন্ধুর বাড়ি...কোনও কিছুতেই আমার আপত্তি
নেই...খালি আমাকে রান্না না করতে হলেই হল...:)॥ভাল খাওয়ার সঙ্গে একটা ভাল আড্ডা
মারার গ্রুপ যদি যোগাড় করা যায়...ইত্যাদি নানাবিধ বিষয় নিয়ে আমার মস্তিষ্ক নামক
যন্ত্রটি এতটাই ব্যস্ত ছিল যে, ‘Science’ এর প্রবন্ধটি
নিয়ে আলোচনা সভার ব্যাপারটা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। মনে পড়ল, ঠিক আগের দিন বিকেলে। তাও আবার আমার একজন labmate কে প্রবন্ধটি পড়তে দেখে।
আর বেশি কিছু বলার আগে এই প্রবন্ধ সভা
সম্পর্কে একটু বলা দরকার।এই বৈজ্ঞানিক
আলোচনা সভার আমাদের ল্যাবে পোশাকী নাম হল "জার্নাল ক্লাব'। সভার অধিবেশন পরিচালনা করেন, আমার গাইড। কখনো তিনি
নিজেই সমগ্র প্রবন্ধটির সারমর্ম আমাদের সামনে তুলে ধরেন, আবার কখনো
আমাদের, মানে তার ছাত্রছাত্রীদের অনুরোধ (পড়ুন আদেশ) করেন, ব্যাপারটা
প্রাঞ্জল করে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য....আর সেখানেই হচ্ছে আসল বিপদ। সভাপতি যদি
আমাকে সেই গুরুদায়িত্ব দিয়ে বসেন, সেই ভয়ে আমাদের প্রবন্ধটি আগেভাগেই পড়ে, তার মর্ম
উদঘাটন করে রাখতে হয়।...অতএব আগের দিন বিকেলে যখন আমার হুঁশ ফিরলো...ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে...
যাই হোক, সেদিন রাতে অনেকক্ষণ পর্যন্ত জেগে থেকে, ফেসবুক, whatsapp, Gtalk, সব কিছুর প্রলোভন বর্জন করে, অনেক কষ্টে অর্ধেক প্রবন্ধের মর্মদ্ধার করে আমি
ক্ষান্ত দিলাম।
পরের দিন, ল্যাবে গিয়ে একে একে সকলকে জিজ্ঞাসা করে
ফেললাম, যে কে কতখানি পড়েছে?...মানে পরোক্ষভাবে আমি নিজের দল ভারী করতে চাইছিলাম
যে, ফাঁকিবাজ খালি আমি একা নয়।...সকলেই এক
বাক্যে স্বীকার করলো যে, তারা মোটেও সম্পুর্ন প্রবন্ধটা পড়ে উঠতে
পারেনি। আমি তো বেজায় খুশি, কেউই যদি না পড়ে থাকে, তাহলে খুব একটা চাপ নেই।...কিন্তু আমার এই আনন্দ
অচিরেই বুদ্বুদ এর মতো মিলিয়ে গেল...যখন সভাপতি সকলকে একে একে প্রবন্ধের একেকটি
অংশ এক্সপ্লেন করতে বললেন। আর তখনই আমি
আবিষ্কার করলাম যে, কেবল আমি ছাড়া বাকি সকলে বেশ ভালমতই পড়া তৈরি করে এসেছে.... পড়া
না পারার থেকেও, বন্ধুদের পড়া তৈরি করেও আমাকে মিথ্যা প্রবোধ
দেওয়ার দুখে আমি বেশি কাতর হয়ে পড়লাম। সবাই আমার কাছে মীরজাফর হিসেবে প্রতিপন্ন হল।
আলোচনা সভার শেষে, এক ডজন গোল খাওয়া গোলকীপার এর মতো মুখ
করে বাড়ির পথ ধরলাম।
ট্রেনে উঠে একটি জানলার ধরে জায়গা পেয়ে বসে পরলাম, বাইরে ততক্ষণে সুয্যিমামা সমস্ত গাছপালা, বাড়িঘর, মাঠঘাট সোনালী আলোয়ে ডুবিয়ে পাটে বসেছেন...ট্রেন
ছুটে চলেছে...আর আমি ঠিক সেই সময় টাইমমেশিনে চেপে ফিরে চলেছি আমার ছোটবেলায় স্কুলে
পরীক্ষার দিনগুলিতে।
মনে আছে, স্কুলে আমার কিছু বন্ধুর কথা...যারা সব পরীক্ষার
শেষেই দুখী দুখী মুখ করে আলোচনা করত …যে তাদের পরীক্ষা কত সাংঘাতিক খারাপ হয়েছে।
প্রায় অর্ধেক প্রশ্নের কোনও উত্তরই তারা লিখতে পারেনি।কোনও রকমে হয়ত টেনেটুনে পাশ করবে...কিন্তু
একটু শক্ত দিদিমনির হাতে খাতা পড়লে, তারা পাশ নাও করতে পারে। আমার তখন বন্ধুদের
জন্য মন খারাপ করত। আর আমি নিজে কেন ওদের থেকে বেশি প্রশ্নের উত্তর লিখে ফেললাম, সেইজন্য নিজেকেই মনে মনে অপরাধী ঘোষণা করতাম। কিন্তু
রেজাল্ট বেরলে দেখা যেত, আমার সেইসব বন্ধুরা বেশ ভাল নাম্বার নিয়েই
পাশ করেছে...আর আমি মাথা নিচু করে দাড়িয়ে মায়ের কাছে বকা খাচ্ছি আর পায়ের বুড়ো আঙুল
দিয়ে মাটিতে গর্ত করছি।
সেই ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত আমার কিছুতেই মাথায় ঢোকে
না, যে ভাল পরীক্ষা দিয়ে, “আমার পরীক্ষা খুব খারাপ হযেছে” এটা বলার কারণ কী?
আর একটা মজার ঘটনা মনে পড়ল...ক্লাস বোধহয় তখন সেভেন...অ্যানুয়াল
পরীক্ষার সব থেকে শেষ পরীক্ষা...অংক পরীক্ষা...কোয়েশ্চান পেপার বেশ কঠিন হযেছে....আসল
অঙ্কের থেকে, মার্জিনের ডান দিকে রাফ করছি বেশি।সতর্ক পাহারা
দিছেন তনুশ্রী দি। এদিক থেকে ওদিকে ঘাড় ঘোরানোর উপায় নেই।...পরীক্ষা যত শেষের দিকে
এগিয়ে আসছে, তত হলের মধ্যে উশখুশনি বেড়েই চলেছে....মাঝে
মাঝে সোনা যাচ্ছে ফ্যাচ ফ্যাচ করে কান্না..... ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রমশই
পিছিয়ে পারছি...অবশেষে বেজে গেল ওর্নিংবেল আর তার ঠিক পনের মিনিট পরেই ফাইনাল ঘণ্টা....খাতা
চলে গেল দিদিভাই এর জিম্মায।
চাঁদা, কাঁটাকম্পাস্স, পেন্সিলকম্পাস্স গুছিয়ে নিলাম...মনে মনে হিসাব করে
দেখলাম...মোটামুটি পাশ করে যাব। যাই হক, পরীক্ষা মোটামুটি হওয়ার দুখের থেকে পরীক্ষা
শেষ হওয়ার আনন্দে আমি বেশ হাসি হাসি মুখ করেই বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু স্কুল কম্পাউণ্ড
এর বাইরে বেরিয়ে বুঝলাম, অবস্থা বিশেষ সুবিধের নয়।...আমার অনেক বন্ধুই মায়ের
আঁচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদছে...কাকিমারা যতটা সম্ভব সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন...আর দূরে
কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে আমার মা একরাশ উদ্বেগ মাখা মুখ নিয়ে দাড়িয়ে আছে। মায়ের কাছে যেতে
মা পিঠ থেকে ব্যাগটা নিয়ে আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করলেন. “কী রে বাবু, কেমন হল?”..আর আমি যথারীতি বোকার মতো বলে ফেললাম “ভালো”...খুব
জোরে যদিও বলিনি...তবে ভালো পরীক্ষা দিয়ে যে চুপিচুপি বলতে হবে, এটা তখন আমার মাথায় আসেনি। আর যেই না বলা, অমনি আশেপাশের সব কাকিমা দের চোখ ঘুরে গেল আমার দিকে...সকলের
চোখের ভাষা আমি পড়তে না পারলেও আমার মা ঠিকই বুঝে ছিলেন যে, ওখান থেকে মানে মানে আমায় নিয়ে সরে পরা উচিত। অগত্যা
মায়ের হাত ধরে হাঁটা দিলাম বাড়ির পথে...মনে পরীক্ষা শেষের ফুর্তি...ছুটিতে কোথায় যাব, সকালে কত দেরি করে ঘুম থেকে উঠবো, এইসব সাত পাঁচ ভাবছি...হঠাত্ দেখি, আমার মা
এর মুখখানা শুকনো...তড়িঘড়ি জিজ্ঞাসা করি, মা তুমি কী আমার পরীক্ষা খুব ভাল না হওয়ায়
রাগ করেছ?...মা একটা ছোট্ট নিশ্বাস গোপন করে বলল “নারে বাবু, তুই যতটা পেরেছিস লিখেছিস...কিন্তু আমার চিন্তা
অন্যখানে...এই যে এত বড় হয়েও তুই এখনো কোথায় কী বলতে হয়, কিভাবে বলতে হয় সেটা শিখলি না..!!!বোকা মেয়ে তুই
একটা”
মাযের কথাগুলো এত দিন পরে আবার মনে পড়ে গেল। স্কুল, কলেজ ইউনিভার্সিটি পেরিয়ে বুড়ো হতে চললাম ....এরকম
নয় যে আমি এখনো ওই একিরকম ক্যাবলা আছি...কিন্তু আমার কপাল মন্দ...যদি আমি বেশি চালাকি
করে কোনও দিন ভালো পরীক্ষা দিয়েও বলি খারাপ পরীক্ষা দিয়েছি, বা কোনও দিন পড়া তৈরি করে ভালো মানুষের মতো বলি যে...আমি
বই এর মলাটটা উল্টেও দেখিনি...তাহলে সত্যি সত্যি আমার পরীক্ষা খুব খারাপ হয় বা আমি
দিদিমণিদের কাছে বকা খাই....কী আর করা যাবে?...বন্ধুদের
দোষ দিয়ে লাভ নেই....আমারও নন্দলালের মতই মন্দকপাল।